দীর্ঘ ত্রিশ বছর পর বাল্যবন্ধু মির্জা’র সাথে দেখা। আমাকে দেখেই সে জড়িয়ে ধরে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। দুই বন্ধুর বিস্তর স্মৃতিপট লোচনযুগলে ভেসে উঠে।
মির্জা’র বাবা সরকারি চাকুরে ছিলেন। তার বাবার বদলিসূত্রে উখিয়া আসা এবং উখিয়া সরকারি মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া। আমার বাড়ির পাশে ভিসিআর হাজির বাসায় ভাড়া থাকার সুবাদে আমার সাথে ঘনিষ্ঠতা একটু বেশিই ছিল। বিদ্যালয়ে একসাথে যেতাম এবং একই বেঞ্চে পাশাপাশি বসতাম।
কুশল বিনিময়ের পর চট্টগ্রাম শহরের লালখান বাজারে একটি রেস্টুরেন্টে বসে কপির কাপে চুমুক দিতে দিতে আড্ডায় মেতে ওঠি। খানিকক্ষণ পর মাস্টার করিমও এসে যোগ দেয়। তিন বন্ধুর আলাপচারিতায় উঠে এলো পঞ্চম শ্রেণির স্মৃতিকথা।
আমাদের সহপাঠী বাবুলের বাড়ি স্কুল থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে। স্কুলে আসা- যাওয়ার জন্য তার বাবা তাকে একটি সাইকেল কিনে দিয়েছিলেন। কিন্তু বাবুল পায়ে সাইকেলের প্যাডেল লাগ পেত না। একদিন বই গুলি ক্যারিয়ারে বেঁধে টপটিউব ও ডাউনটিউবের মাঝখান দিয়ে পা ঢুকিয়ে শরীর বাঁকা করে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে এসেছিল। এটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় স্যারেরা সাইকেল নিয়ে আসতে বারণ করেন। কী আর করার রিক্সায় করে স্কুলে আসা – যাওয়া করতে হয়।
একদিন বাবুল আর লিজা (ছদ্মনাম) একই রিক্সায় পাশাপাশি বসে স্কুলের সামনে এসে নামে। এইদৃশ্য সহপাঠীদের কেউ কেউ দেখে বিষম এক আইফের কাজ পরিগণিত করে চদনায় লিপ্ত হয় ( আইফ – অশোভন কাজ, চদনা- কুৎসা রটনা)। এক কান দুই কান হয়ে চদনার ডাল-পালা, শাখা-প্রশাখা বিস্তার লাভ করে ক্লাসের সবার কানে ছাউর হয়ে যায়। কেবল বাবুল আর লিজা জানত না।
কেউ বলে, বাবুল লিজাকে কোলে করে স্কুলে এনেছে, কেউ বলে, ঘেঁইত (কাধেঁ) করে এনেছে আবার কেউ বলে তার সাইকেলের ফ্রন্ট সিটে বসিয়ে এনেছে।
একদিন অ্যাসেম্বলি ক্লাস শেষে শ্রেণি কক্ষে ঢুকে দেখি ব্লাকবোর্ডে বড় বড় অক্ষরে লেখা “বাবুল + লিজা”। এটি দেখে সবাই মুচকি মুচকি হাসে আর কানাঘুষা করে। মুকন্দ স্যার ক্লাসে প্রবেশ করেই সবাইকে হাসি-হাসি চেহারা দেখে কী হয়ছে জিজ্ঞাস করেন। কেউ কোন জবাব দেয় না। কেবল একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে হাসে। একপর্যায়ে ব্লাকবোর্ডে স্যারের চোখ পড়ল। সাথে সাথে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে জিজ্ঞেস করলেন, “এটি কে লিখেছে”? কারো কোন জবাব নেই। স্যার হুংকার ছেড়ে বলেন, কে লিখেছ বলো, না হলে সবার পিঠের চামড়া তুলে ফেলব। এবারো সবাই নিরোত্তর। সবার হাসি মুখ নিমিষে পানসে হয়ে যায়।
ক্লাস ক্যাপ্টেন খোরশেদকে দাঁড় করিয়ে বলেন, তুমি বলো, কে লিখেছে?
এবার আমি ভয়ে আঁতকে উঠলাম। কারণ সে তো আমার নামটিই বলবে। স্যারেরা ক্লাস থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় যারা কথা বলবে, তাদের নাম লেখার জন্য ক্লাস ক্যাপ্টেন খোরশেদকে দায়িত্ব দিতেন। আর সে খাতাটা নিয়েই আমি কথা বললেও, না বললেও, বিছমিল্লাহ্ বলে প্রথমে আমার নামটি লিখত। যেন আমি তার পাতের ভাত কেড়ে খেয়েছি। দুই নাম্বারে পলাশের নাম, তিন নাম্বারে কাশেমের নাম। মাঝে মধ্যে জিয়ার নামটিও জুড়ে দিত। পরে স্যার ক্লাসে আসলে অতিশয় দায়িত্বশীল ক্যাপ্টেন হিসেবে তালিকাটি টেবিলে দিত আর স্যার আমাকে দিয়ে শুরু করতেন।
লিজা আর বাবুলের প্রণয়াকাঙ্ক্ষা তখনো জাগ্রত হয়েছিল কি না জানি না। তবে সেদিনের জিজ্ঞাসাবাদ চলাকালীন দুজনকে বেশ শরমনমিত দেখা গিয়েছিল। দুজন দুজনকে আড়চোখে দেখতেও ভুলেনি।
খোরশেদ উত্তর দিলো- আমি দেখি নাই, স্যার।
স্যার এবার খোরশেদকে আদেশ দিলেন- যাও লম্বা দেখে পাঁচটি বেত নিয়ে এসো।
ফার্স্ট বয়দের শিক্ষকরা অতি আদর করতেন। তাদের সাত খুন মাপ। মার খেতে হয় না, বকা শুনতে হয় না। পাঁচটা আনতে বলেছেন, সে নিশ্চয় দশটা নিয়ে হাজির হবে। আর আমাকে দিয়ে যাত্রা শুরু হবে।
খোরশেদ হাইস্কুল পাহাড়ের হাইন্দা (ঢালু) থেকে এক ডজন চিকন লম্বা ইচ্চি গাছের বেত নিয়ে জুত করতে করতে হাসি হাসি মুখে ক্লাসে হাজির। আমি যা ভাবছি, তার চেয়ে বেশি এনেছে। মুকন্দ স্যার শেষ বারের মতো জিজ্ঞেস করলেন, কে লিখেছে? সবাই মাথা নিচু করে নিরোত্তর রইল।
এবার খোরশেদকে তুমি কিসের ক্যাপ্টেন, কে লিখেছে দেখ নাই, বলেই মাথাটি টেবিলের নিচে ঢুকিয়ে, তার আনা লম্বা একটি বেত দিয়ে ছুঁৎ ছুঁৎ বারি মারা আরম্ভ। নিয়মিত প্রথার বাইরে প্রথমে ক্যাপ্টেন কে দিয়ে শুরু করায় আমরা সবাই ভয়ে মূর্ছা যাওয়ার অবস্থা।
আমার পাশের বেঞ্চে বসা উজ্জল কান্তি দে আর রূপন বিশ্বাস দুর্গা-দুর্গা- দু-র্গা বলে ফিসফিস করে দুর্গানাম জপছে। আমার পিছনে বসা খালেক অতি দরদমাখা কণ্ঠে দোয়া ইউনুছ পাঠ করছে। খোরশেদের পিঠে বারি যত জোরে পড়ে, দুর্গানাম জপ আর দোয়া ইউনুছ পাঠের শব্দও তত জোরে বের হচ্ছে। তাদের জপমালা শুনতে শুনতে আমার তলপেট ভারী হয়ে আসল। কাপড়ে-চোপড়ে হওয়ার আশঙ্কায় দাঁড়িয়ে বললাম, স্যার একটু বাইরে যাব।
-কেন?
প্রস্রাব করব।
– কারো প্রস্রাব চাপল না। তোমার চাপল। নিশ্চয় তুমি লিখেছ।
না, স্যার। আমি লিখি নাই।
– আচ্ছা। যাও। সেরে এসো। তার পর তোমাকে ধরব। আমি বাহির থেকে এসে বসলাম। সামনের দুই বেঞ্চ শেষ হয়েছে। তৃতীয় বেঞ্চের করিম, মির্জা আর আমাকে পর্যায়ক্রমে ধরবে। মির্জা আমাকে কানে কানে বলল- “দোস্ত আমার তো বড়টার বেগ পাইছে। ছোটটার কথা বলায়, তুকে সন্দেহ করছেন। আমি বড়টার কথা বললে নিশ্চিত দোষী সাব্যস্ত হব”।
আমি বললাম- বলার দরকার নাই। ঝিমখাড়ি থাক।
বাবুল ব্যতীত একে একে সকল ছাত্রদের উপর খোরশেদের আনা বারোটি বেত শেষ করলেন।
মনে মনে বলি, স্যার এটা কেমন বিচার করলেন। মেয়েরাও তো লিখতে পারে। আর বাবুল কেন মেয়েদের দলে। সে কি লিখতে পারে না?
কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন-
বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর।
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
তাহলে কি যাকিছু অকল্যাণকর তার পুরোটাই পুরুষে করেছ?
ক্লাস শেষে স্যার বের হওয়ার সাথে সাথে পলাশ চিল্লান দিয়ে বলে ওঠল কোন — –নির পুত লিখেছ? আর সবাইকে মার খাওয়াইছ।
তার প্রতি মাইর মনে হয় একটু বেশি হয়েছে। —-নির ঝিও তো লিখতে পারে।
বশর বলল- জিয়া লিখেছে। গত কাল টিপিন পিরিয়ডে নুর হোটেল থেকে পরোটা এনে জিয়া নিজ হাতে লিজাকে খাওয়াই দিতে দেখেছি।
আমি নিশ্চিত খোরশেদ লিখেছে। কারণ বাবুল আর খোরশেদ একে অপরের বড়ায়ি (বড়ায়ি- দুইয়ের সংযোগ সৃষ্টিকারী বা অনুঘটক, যে রাধাকৃষ্ণের মিলন ঘটিয়েছিল)। নাহলে কে লিখেছে, তা স্যার আসার সাথে সাথেই সে বলে দিত। যাহোক,৩৫ বছর পরে এসেও মির্জা’র সেই একই প্রশ্ন, সেদিন এটি কে লিখেছিল?
লেখক-
পুলিশ পরিদর্শক,
সদর দক্ষিণ সার্কেল অফিস, কুমিল্লা।
তারিখ- ১/৪/২০২৩ খ্রি.