সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ০২:২২ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
শিরোনাম :
উখিয়ার ঘাটে রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর তাণ্ডব: পারিবারিক বিরোধের জেরে রক্তাক্ত সংঘর্ষ যেকোনো সময় সচল করা হতে পারে আ.লীগের কার্যক্রম: ড. ইউনূস মাদক ছিনতাই থেকে পাচার—সবখানেই সক্রিয় পালংখালীর মঞ্জুর আলম তাঁতীলীগ নেতাকে ছেড়ে দিয়ে সংবাদকর্মীকে গ্রেফতার করলেন উখিয়ার ওসি! কক্সবাজারে শিক্ষিকা ধর্ষণ মামলায় ৩ জনের যাবজ্জীবন জাতিসংঘে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব বিপুল ভোটে পাস অভিযোগ, বর্জন, বিক্ষোভের ভোট, ফলের অপেক্ষা কুতুপালং বাজার ব্যবসায়ী সমিতি নির্বাচন ঘিরে আলোচনায় মোহাম্মদ ইমরান উচ্ছেদ কার্যক্রমে বাধা: ২৯ জনের নাম উল্লেখসহ ১ হাজার জনের বিরুদ্ধে মামলা পদত্যাগ করছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী

কক্সবাজারে দুর্ধর্ষ দুই সহোদরের জমি প্রতারণা

ডেস্ক রিপোর্ট / ১০৭ বার
আপডেট সময় : মঙ্গলবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

শাহীন মাহমুদ রাসেল:-

কক্সবাজার শহরে আবির্ভূত হয়েছে দুই দুর্ধর্ষ প্রতারক। তাদের ভয়ঙ্কর প্রতারণার ফাঁদে পড়ছেন স্থানীয় ব্যবসায়ী, বিত্তশালী পরিবার, এমনকি প্রবাসীরাও। জমির মালিক পরিচয়ে চাঁদাবাজি, আদালতে ভুয়া তথ্য উপস্থাপন, দলিল জালিয়াতি- কোনো কৌশলই বাদ রাখেননি তারা। অভিযোগ উঠেছে, এভাবে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়ে গড়ে তুলেছেন এক বিশাল প্রতারণা সাম্রাজ্য।

শহরের রুমালিয়ারছড়া এলাকার বাসিন্দা সহোদর দিদারুল আজম ও রায়হান উদ্দিন হচ্ছেন এই চক্রের মূল হোতা। দীর্ঘদিন ধরে তারা জাল কাগজপত্র তৈরি করে জমির মালিক সেজে প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। ভুয়া এনআইডি, ওয়ারিশ সনদ, খতিয়ান ও হেবা দলিল ব্যবহার করে আদালতে মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করা এখন তাদের নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

ভুক্তভোগীরা জানান, দুই সহোদরের প্রধান টার্গেট জমি-সম্পত্তি। সুযোগ বুঝে তারা একই জমি একাধিক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দেন, আবার কখনো অগ্রিম টাকা নিয়ে আর দলিল সম্পন্ন করেন না। প্রকৃত মালিককে জিম্মি করে আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে জমিতে প্রবেশও বাধা দেন। আদালতপাড়ায় দিদারুল আজমকে এখন ‘মামলাবাজ’ নামে ডাকা হয়। এ পর্যন্ত ১৫ থেকে ১৮টি মামলা ঠুকে মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছেন তিনি। উদ্দেশ্য একটাই- হয়রানি করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতানো।

আমিন নামের এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘আমরা জমি কিনেছি শান্তিপূর্ণভাবে ব্যবহার করার জন্য। কিন্তু হঠাৎ একদিন দেখি, দিদারুল আর রায়হান হাজির, নিজেদের মালিক দাবি করছে। আদালতে গিয়ে দেখি, আমাদের নামে জাল কাগজপত্র জমা পড়েছে।’

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্রতারণা চক্রকে ছায়া দিয়ে যাচ্ছেন আলোচিত পাওয়ার আলীর ভাই মাহমুদুল করিম। অভিযোগ আছে, দিদার-রায়হানের সঙ্গে তার নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে আদালতপাড়ায় ও জমি দখলের ঘটনায় তাকে সহযোগী হিসেবে দেখা গেছে।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, ঝিলংজা মৌজার বি.এস. ১৮০০ নং খতিয়ানভিত্তিক জমি নিয়ে দিদার-রায়হানের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। রেকর্ড অনুযায়ী ওই জমির মালিক ছিলেন নুরুল হক। মৃত্যুর পর তার স্ত্রী ও সন্তানরা জমির উত্তরাধিকারী হন। ২০১২ সালে জমির একটি অংশ বিক্রি হয় আখতারুজ্জামান খানের কাছে। পরে একাধিকবার মালিকানা পরিবর্তন হয়ে ২০২৫ সালের জুনে প্রবাসী নিয়াতম উল্লাহ শান্তিপূর্ণভাবে দখল নেন।

কিন্তু এর মধ্যেই ২০১৪ সালের ৩ মার্চ কক্সবাজার সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে রায়হান উদ্দিন ও এক নুর মহল বেগমের নামে একটি হেবা ঘোষণাপত্র তৈরি করা হয়।

কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ওই মৌজায় নুর মহল বেগম নামে কোনো রেকর্ড নেই। আবার রায়হানের মায়ের নাম নুর আয়েশা বেগম। তবু জাল দলিল ব্যবহার করে সহকারী কমিশনার, তহশিলদার ও সার্ভেয়ারের সহযোগিতায় নামজারী সম্পন্ন করা হয়। এর মাধ্যমে কোটি টাকার জমি একাধিকবার বিক্রি করে দেন অভিযুক্তরা।

সম্প্রতি পুলিশের বিশেষায়িত সংস্থা পিবিআই তাদের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর প্রতারণার প্রমাণ পেয়েছে। সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, কলাতলী বাইপাস এলাকায় প্রকৃত মালিকানা গোপন করে জাল হেবা দলিল সৃজন করে জমি বিক্রি করেছেন তারা। এতে ভূমি অফিসের কয়েকজন কর্মচারীর সম্পৃক্ততারও প্রমাণ মেলে।

পিবিআইয়ের সহকারী উপপরিদর্শক মো. নিজাম উদ্দিনের জমা দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়- দিদারুল আজম ও রায়হান উদ্দিন যোগসাজশে জাল দলিল তৈরি করে জমি আত্মসাৎ করেছেন। ২৮ আগস্ট আদালতে প্রতিবেদনটি দাখিল করা হয়। সরেজমিন তদন্তেও জমির প্রকৃত মালিকানা নিয়াতম উল্লাহ ও আমিন উল্লাহর বলে নিশ্চিত করা হয়েছে।

অভিযোগকারী নিয়াতম উল্লাহ বলেন, ‘আমি একজন রেমিট্যান্সযোদ্ধা। বিদেশে মাথার ঘাম মাটিতে ফেলে কষ্টার্জিত অর্থ পাঠিয়ে জমি কিনেছি। কিন্তু দিদার-রায়হান চক্র আমাকে হয়রানি করছে। তারা মালিক না হয়েও আদালতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে আমার জমি দখল করার চেষ্টা করছে।’

তার আক্ষেপ, ‘আমাদের কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে কেনা জমি প্রতারকরা হরণ করছে, অথচ আমরা কোনো সুরাহা পাচ্ছি না। বরং উল্টো আমরা হয়রানির শিকার হচ্ছি।’

আরেকজন প্রবাসী জানান, ‘একই জমি একাধিকবার বিক্রি করেছে তারা। আমরা প্রতারণার শিকার হয়ে নিঃস্ব হয়েছি। অনেকেই জীবনের সঞ্চয় হারিয়ে পথে বসেছেন।’

ভুক্তভোগীরা বলেন, আদালতে মামলা করলেই উল্টো তারা প্রতিশোধ নেন। ভুয়া কাগজ দিয়ে নতুন মামলা ঠুকে দেন। এক পর্যায়ে ভুক্তভোগীরাই বিবাদী হয়ে আদালতে দৌড়ঝাঁপ করতে থাকেন। ফলে প্রতারকদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে গিয়ে আরও হয়রানির শিকার হচ্ছেন তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘নিজের জমি নিয়ে এমন প্রতারণা কল্পনাও করিনি। তাদের দাপট এতটাই যে প্রশাসনও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।’

অভিযুক্ত রায়হান উদ্দিন দাবি করেন, সবকিছু তার বড় ভাই দিদারুল আজম দেখাশোনা করেন। আর দিদারুল আজম বলেন, ‘প্রবাসীরা ভিন্ন দাগের জমি কিনেছেন। হুমায়ুন কবির যে মামলা করেছেন, তা মিথ্যা। পিবিআই প্রভাবিত হয়ে ভুয়া প্রতিবেদন দিয়েছে। আমরা আইনি ব্যবস্থা নেব।’

স্থানীয়রা জানান, একের পর এক প্রতারণার প্রমাণ সামনে এলেও প্রশাসন কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। বরং ভুক্তভোগীরাই মামলার জালে জড়িয়ে পড়ছেন। এতে দিদার-রায়হান জুটি আরও দুর্ধর্ষ হয়ে উঠছে।

স্থানীয় এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমাদের শহরে প্রতারণা এখন এক আতঙ্কের নাম। অথচ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা চুপ। দুদক কিংবা আদালতে অভিযোগের পাহাড় জমলেও তাদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড থামছে না।’

তার মতে, দিদারুল আজম ও রায়হান উদ্দিন শুধু জমি প্রতারণাই নয়, আদালতকে বিভ্রান্ত করা, অগ্রিম টাকা হাতিয়ে নেওয়া, চুক্তি ভঙ্গ করা- এসব কাজও নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছেন। শহরের একাধিক মৌজায় তাদের প্রতারণার ছাপ রয়েছে। প্রতিনিয়ত ভুক্তভোগীর তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে।

আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করে তারা মামলা থেকে রেহাই পেতে অভ্যস্ত। এভাবেই প্রতারণার সাম্রাজ্য বিস্তৃত করে গেছেন।

যেখানে পিবিআইয়ের মতো সংস্থা জালিয়াতির প্রমাণ হাজির করেছে, সেখানে কেন দিদার-রায়হানকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না? কেন প্রশাসন নীরব? এমন প্রশ্ন সংশ্লিষ্টসহ স্থানীয়দের।

কক্সবাজারে প্রতারণার আরেক নাম হয়ে উঠেছে দিদারুল আজম ও রায়হান উদ্দিন। তাদের ভয়ঙ্কর কৌশলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন প্রবাসী, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ। প্রশাসনের নীরবতা আর আইনের ফাঁকফোকরের সুযোগে তারা দিন দিন আরও দুর্ধর্ষ হয়ে উঠছেন। প্রতারণার জাল ভেঙে তাদের আইনের আওতায় না আনলে ভুক্তভোগীর তালিকা শুধু দীর্ঘই হবে না, বরং শহরের জমি-সম্পত্তি নিয়ে নতুন সংকটও তৈরি হবে। এমনটাই মনে করছেন আইনজীবীসহ স্থানীয় সচেতন মহল।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর
এক ক্লিকে বিভাগের খবর