শাহীন মাহমুদ রাসেল, কক্সবাজার ::
কক্সবাজারের উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আরিফ হোসেনের বিরুদ্ধে মাদক সংশ্লিষ্টতা, ঘুষ বাণিজ্য, নিরীহ মানুষকে ফাঁসানো, মামলার নামে হয়রানি, জব্দকৃত মাদক গায়েব, মাসোহারা আদায়সহ একের পর এক ভয়ঙ্কর অভিযোগ উঠছে। স্থানীয়দের ভাষায়, ‘উখিয়ায় আইন নয়, চলে ওসির নিয়ম।’
একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র ও ভুক্তভোগীর অভিজ্ঞতা বলছে, থানায় চলছে অঘোষিত চাঁদার রাজনীতি। নিয়মিত মাসোহারা নিচ্ছেন ওসি সাহেব- মাদকের গডফাদার, গাড়ি মালিক, ব্যবসায়ী, এমনকি সাধারণ নিরীহ মানুষকেও ছাড় দিচ্ছেন না।
থানার মালখানায় আটক ইয়াবা ‘এক্সচেঞ্জ’ করে বাজারে বিক্রির অভিযোগ পুরনো নয়। সুত্র বলছে, ভালো ইয়াবা বদলে দেওয়া হচ্ছে নষ্ট বা নিম্নমানের মাল দিয়ে। এগুলো চালাচ্ছে একদল ‘বহিরাগত সহযোগী’, যাদের কাজকর্ম চলেও পুলিশ প্রহরায়। এসআই প্রভাকরকে সরিয়ে এই দায়িত্ব দেন ওসি নিজে। এখন দায়িত্বে রয়েছেন এসআই রনতুষ। থানার মালখানা থেকে একাধিকবার ইয়াবা গায়েবের ঘটনায় স্থানীয় সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজ প্রতিবাদ জানালেও ব্যবস্থা হয়নি।
ভুক্তভোগীরা জানান, টাকা না দিলে মামলা নেয় না থানা। আবার টাকা দিলে নিরীহ মানুষকে ‘ম্যানেজড’ মামলায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।
থ্যাংখালী, পালংখালী, বালুখালী- এই সব অঞ্চলে একাধিকবার নিরীহ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা হয়েছে। গার্ড অব অনার পেয়েছেন আসল অপরাধীরা।
তথ্য বলছে, উখিয়ার হাজীরপাড়া এলাকায় মেহেদী হাসান নামে এক তরুণের মোটরসাইকেল ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় নাটকীয় মোড় নেয় পরদিনই। ওই ঘটনায় ভুক্তভোগী নিজেই সাংবাদিকদের বলেন, হামলাকারীরা ছিল মুখ বাঁধা, সংখ্যা ৪ থেকে ৫ জনের বেশি নয় এবং তিনি কাউকে চিনতে পারেননি।
তবু এজাহারনামায় আসামি করা হয় ৮১ জনকে। স্থানীয়দের অভিযোগ, মোটা অঙ্কের লেনদেনের বিনিময়ে ওসি মো. আরিফ হোসেন একটি প্রভাবশালী পক্ষের হয়ে মামলার দায়দায়িত্ব ঘুরিয়ে দেন অন্যদের কাঁধে। ফলে ওই মামলায় অন্তত ৭০ থেকে ৮০ জন নিরীহ মানুষ ফেঁসে যান, যাদের অনেকের ওই সময় ঘটনাস্থলে থাকার প্রমাণও ছিল না।
এলাকাবাসীর ভাষ্য, এটা ছিল প্রতিহিংসামূলক মামলা। মূল হামলাকারীদের বাদ দিয়ে নিরীহদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকা থেকে ইয়াবাসহ আটক এক মাদক কারবারিকে আটকের পর ছেড়ে দেওয়ার ঘটনার জেরে ৮-এপিবিএনের উপপরিদর্শক (এসআই) জাহাঙ্গীরকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হলেও, মামলার মূল নিয়ন্ত্রক ওসি মো. আরিফ হোসেন পুরো ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেও রয়েছেন অধরা।
এসআই জাহাঙ্গীর নিজেই বলেন, আমি তো মামলা নিতে পারি না, মামলা নেয় থানার ওসি। তাকে ধরে থানায় নিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু ওসি বললেন এগুলো নষ্ট ইয়াবা, তাই মামলা নেননি। এতে আমার কিছুই করার ছিল না।
এই বক্তব্যের সত্যতাও মিলেছে। প্রতিবেদকে ওসি আরিফ হোসেন স্বীকার করে বলেন, তাকে আমার কাছে আনা হয়েছিল। সেগুলো ইয়াবা ছিল না, তাই মামলা নিইনি।
স্থানীয় সূত্র বলছে, উদ্ধার হওয়া ইয়াবার প্রকৃত পরিমাণ ছিল প্রায় ৭ হাজার পিস। যার বড় একটি অংশ গায়েব হয়ে যায়, কিন্তু তার কোনও লিখিত রেকর্ড বা মামলা হয় না।
এই ঘটনায় ওসির স্পষ্ট জড়িত থাকার অভিযোগ থাকলেও শুধুমাত্র নিচতলার একজন কর্মকর্তাকে দায়ী করে শাস্তি দেওয়া হয়েছে- যা নিয়ে ক্ষোভে ফুঁসছে স্থানীয় অধিকারকর্মী ও সাংবাদিক সমাজ।
তারা বলছেন, আসল হোতা রয়ে গেলেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, আর বলির পাঠা বানানো হলো একজন এসআইকে। এটা শুধু বিচারহীনতার নজিরই নয়, বরং প্রশাসনের ছত্রছায়ায় দুর্নীতির আরও একটি রূপ। তাদের ভাষায়, শাস্তি হয় কেবল ছোটদের, বড়দের কখনও জবাবদিহি করতে হয় না। এটাই উখিয়ার বাস্তবতা।
অভিযোগ আছে, উখিয়ায় হাজারো ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলে পুলিশের চুক্তিতে। সিএনজি থেকে ট্রাক পর্যন্ত প্রতিটিতে মাসিক টাকা তোলা হয়। এই চাঁদার ভাগ যায় তিন জায়গায়- ১ ভাগ থানার ওসির পকেটে, ১ ভাগ হাইওয়ে পুলিশের ফাঁড়িতে, আর ১ ভাগ সংশ্লিষ্ট সমিতিতে।
কোটবাজার সিএনজি সমিতির লোকজন নিজেরাই অন্তত ৫০০ গাড়ি থেকে ওসিকে নিয়মিত টাকা দেন বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেন।
অভিযোগ আছে, উখিয়া-পালংখালী সীমান্ত ঘেঁষা এলাকা থেকে চিহ্নিত রোহিঙ্গা মাদক কারবারি আলমগীর, মাহমুদুল হক ও তার ছেলে ছোটন- তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মাদক সংশ্লিষ্ট অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও একটি মারামারির মামলার চার্জশিট থেকে নাম বাদ পড়েছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, মোটা অঙ্কের প্রায় ২ লাখ টাকার বিনিময়ে তদন্ত কর্মকর্তা ও ওসি আরিফ হোসেনের ‘সমঝোতায়’ এ সিদ্ধান্ত হয়।
বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা উঠলেও কোনো তদন্ত হয়নি।
শুধু তাই নয়, জালিয়া ইউনিয়নের পাইন্যাশিয়া এলাকার বাসিন্দা গফুরকে থানায় ডেকে নিয়ে একটি গ্রুপের প্ররোচনায় জিম্মি করে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করা হয়। তিনি টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে রাতারাতি অন্য একটি পুরোনো ঘটনার সাথে জড়িত করে তাকে আসামি করে কারাগারে পাঠানো হয়।
অভিযোগ আছে, গফুরের ‘এন্ট্রি গ্রুপ’ থেকেই ওই টাকা নিয়েছেন ওসি নিজে। ঘটনাটি নিয়ে স্থানীয় একাধিক দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশ হলেও পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনও জবাব মেলেনি।
পালংখালী ইউনিয়নের থ্যাংখালী এলাকায় বিতর্কিত মনিয়া গ্রুপ নামে পরিচিত এক চিহ্নিত সন্ত্রাসী দলের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ওসি আরিফ হোসেন কয়েকজন নিরীহ মানুষের বিরুদ্ধে ভিন্ন ভিন্ন মামলায় চার্জ দেন।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, আসল অপরাধীদের আড়াল করে নিরীহদের ফাঁসানো হয়।
ঘটনার প্রতিবাদে এলাকাবাসী মানববন্ধন করে এবং গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি হামিদুল হক ওসিকে সরাসরি হুঁশিয়ারিও দেন।
জনশ্রুতি রয়েছে, হাজম রোড, ধামনখালী ও বালুখালীর একাধিক চিহ্নিত ইয়াবা কারবারি- যেমন আবছার, মনির ও চিয়ক ফরিদের মাধ্যমে থানার জব্দ ইয়াবা মালখানা থেকে ভালো ইয়াবা সরিয়ে তাদের মাধ্যমে বিক্রি করেন। তার জায়গায় নষ্ট বা নিম্নমানের ইয়াবা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ভালো ইয়াবা বিক্রি করে টাকা ভাগবাটোয়ারা করেন কারবারিরা, থানার ‘লোকজনের’ সঙ্গে।
প্রথমে এই কাজ করতেন এসআই প্রভাকর। ভাগে বনাবনি না হওয়ায় তাকে সরিয়ে বর্তমানে দায়িত্বে আছেন এসআই রনতুষ। তিনি কাজটি পরিচালনা করছেন দুই ‘বহিরাগত সহযোগী’ বাদশা ও আলমের মাধ্যমে।
আভিযোগ আছে, উখিয়ার বৈধ-অবৈধ নানা ব্যবসায়ী যেমন- গাছ ব্যবসায়ী, সাপ্লায়ারের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা নেন ওসি আরিফ হোসেন।
অনেকে অভিযোগ করেছেন, ঈদ-পূজা বা বিশেষ উপলক্ষে ‘উপহার’ বা ‘সালামি’র নামেও চাপ প্রয়োগ করে টাকা আদায় করা হয়।
এমনকি থানায় সরঞ্জাম কেনা বা সংস্কারের নামে নানা খাত দেখিয়ে অর্থ তোলা হলেও বাস্তবে কোনো দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়নি বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, গত ৩১ মে জালিয়াপালং ইউনিয়নের জুম্মাপাড়া এলাকায় পাহাড় কাটাকে কেন্দ্র করে মারামারিতে গুরুতর আহত হন নুর জাহান ও নুরুল হাকিম। ঘটনার পর ভুক্তভোগীরা থানায় অভিযোগ করলেও ওসির নির্দেশে এসআই সৌরভ প্রাথমিক পরিদর্শনের পর আর কোনো আইনি সহায়তা দেননি- এমন অভিযোগ রয়েছে।
পরে ভুক্তভোগীরা আদালতের দ্বারস্থ হলে আদালত মামলা নিতে থানাকে নির্দেশ দেয়। তবে মামলা রুজুর ১৮ দিন পার হলেও পুলিশ কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করেনি।
ভুক্তভোগীর অভিযোগ, এক ইউপি সদস্যের যোগসাজশে টাকা খেয়ে আসামিদের রক্ষা করা হচ্ছে ওসির নির্দেশে। এদিকে বাদীপক্ষ নিয়মিত হুমকির মুখে রয়েছে বলেও জানিয়েছে পরিবার।
উখিয়ায় অনেকে মনে করেন, থানার নিচতলার কর্মকর্তা বা সদস্যরা অনিয়ম করতে না চাইলেও ওসির চাপে তারা বাধ্য।
ওসি আরিফের বিরুদ্ধের ভুক্তভোগীদের একাধিক প্রতিবাদ হয়েছে। থানার সামনে মানববন্ধন, গণমাধ্যমে রিপোর্ট প্রকাশ, এমনকি মন্ত্রীর দপ্তরেও অভিযোগ গেছে- তবুও বহাল তবিয়তে চেয়ার আঁকড়ে বসে আছেন তিনি।
স্থানীয় নাগরিক ফোরামের এক নেতা বলেন, প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও একজন বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তা যদি বারবার পার পেয়ে যায়, তাহলে আইন কোথায়? আমরা কি অপরাধকে সরকারি অনুমোদন দিচ্ছি?
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ওসি মো. আরিফ হোসেন থানায় যোগদানের পর থেকে একে একে ভেঙে পড়েছে পুলিশি দায়িত্ববোধ, ভেঙে গেছে জনআস্থা। তাদের ভাষায়, থানায় গেলে বিচার নয়, হয় বোঝাপড়া। মাদক, মামলা বাণিজ্য, মাসোহারা আদায়, ইয়াবা গায়েব, মালখানা বাণিজ্য, নিরীহ মানুষকে হয়রানি- সব ক্ষেত্রেই তার বিরুদ্ধে আছে ভয়াবহ অভিযোগ। কিন্তু উচ্চমহলের রহস্যজনক নীরবতায় বারবারই পার পেয়ে যাচ্ছেন তিনি।
গণঅধিকার পরিষদের এক নেতা বলেন, ওসি আরিফ হোসেন উখিয়ায় পুলিশ নয়, যেন ইয়াবা-রাজনীতির সমন্বয়ক। মানববন্ধন করেছি, প্রমাণ দিয়েছি- তবুও তার বিরুদ্ধে কেউ টোকা দেয় না। তার পেছনে শক্ত প্রোটেকশন না থাকলে এমন রাক্ষুসে দুর্নীতি সম্ভব না।
থ্যাংখালীর এক বৃদ্ধ বলেন, থানায় গেলে বোঝা যায় কার ক্ষমতা বেশি। ইয়াবা ডনরাই ‘ভিআইপি’। আর গরিব মানুষ ভয় পায় থানায় যেতে। ওসি সাহেবের আশপাশে সবসময় দেখা যায় একাধিক ইয়াবা কারবারিকে। সুত্র : দৈনিক মেহেদী পত্রিকা।