নাফ নদীর এক পাড়ে কক্সবাজারের টেকনাফ অন্য পাড়ে রাখাইনের মংডু শহর। এই নদী বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে যুক্ত। নাফের ওপাড়ে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর চলমান যুদ্ধাবস্থার মধ্যেই তৎপর হয়ে উঠেছে দুই দেশের রোহিঙ্গা পারাপারের দালাল চক্রগুলো। অভিযোগ উঠেছে, অর্থের বিনিময়ে এই চক্রের মাধ্যমে নতুন করে বাংলাদেশে আসছে রোহিঙ্গারা। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীগুলো অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধে তৎপর রয়েছে দাবি করলেও সম্প্রতি কত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে সে সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট তথ্য কোনও কর্তৃপক্ষ দিতে পারেনি। গত কয়েক সপ্তাহে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক।
তারা জানান, প্রাণ বাঁচাতে তারা বাংলাদেশে এসেছেন। বর্ডার পার হতে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের দালালকে টাকা দিতে হয়েছে। আর সীমান্তবর্তী স্থল এলাকা ও নাফ নদী পার করে নাইক্ষ্যংছড়ি, তুমব্রু ও টেকনাফের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ করছে তারা।
নাফ নদে রোহিঙ্গা পারাপারে দালাল চক্র গড়ে ওঠেছে বলে স্বীকার করেছেন টেকনাফের নৌ-পুলিশের ইনচার্জ পরিদর্শক তপন কুমার বিশ্বাস। তিনি জানান, ‘ মিয়ানমারে চলমান যুদ্ধের সুযোগে কয়েকটি দালাল চক্র রোহিঙ্গা পারাপারের বাণিজ্য গড়ে তোলার খবর আমরাও শুনেছি। আমরা সেসব দালালদের শনাক্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কাজ করছি। এছাড়া নাফ নদ দিয়ে যাতে কোনও অনুপ্রবেশের ঘটনা না ঘটে, সেজন্য টহল অব্যাহত রেখেছি। কিন্তু জনবল সংকটের পাশাপাশি নৌযান না থাকায় যখন-তখন অভিযানে নামতে পারি না।’
রাখাইন থেকে প্রথমে হেঁটে নাফ নদীর ওপারের তীরে আসে রোহিঙ্গারা। ওই নদীতীরে নৌকা নিয়ে বসে থাকে দালালেরা। এপারেও একইভাবে বাংলাদেশের টেকনাফ সীমান্তে থাকে দালালেরা। রাতে দুই অংশের দালালেরা টাকা নিয়ে রোহিঙ্গা ঢুকাচ্ছে বাংলাদেশে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দালালরা ২০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার বিনিময়ে উখিয়া-টেকনাফের সীমান্তে রাতের আঁধারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে এ অবৈধ পাচার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এসব কাজে সীমান্তের অন্তত ২০ জনের বেশি নাম পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে রয়েছে- টেকনাফের বদি আলম, হেলাল উদ্দিন, মো. রহিম বাদশা, মো. বলি, নুর মোহাম্মদ, মোহাম্মদ শালমান, মো. শামসুল আলম, মো. জাবেদ, ইমান হোসেন ইউচুপ, মো. ইউনুছ, মো. সিরাজ, আজিজ উল্লাহ, জাফর আলম, মো. জিয়াবুল, মো. শফিক, মুহাম্মদ মান্নান, করিম উল্লাহ, নজির আহমেদ, মো. শফিক, মো. ফারুক, মো. জয়নাল, নুর হোসেন ও মো. সাদ্দাম প্রমুখ। পুলিশের মানবপাচার তালিকায়ও এদের নাম রয়েছে। আছে অনেকের নামে মানবপাচার আইনে মামলাও।
এসব দালাল ১৬টি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসছে। পয়েন্টগুলো হলো- বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি, তুমব্রু, ঘুমধুম, টেকনাফ সীমান্তের জাদিমুড়া, কেরুনতরী, বরইতলী, নাইট্যং, চৌধুরীপাড়া, মৌলভীপাড়া, নাজিরপাড়া, নয়াপাড়া, মেরিন ড্রাইভের খুরের মুখ, মহেষখালীয়াপাড়া, তুলাতুলি ঘাট ও শাহপরীর জালিয়াপাড়া ও গোলারচর। এসব পয়েন্ট একাধিক মানবপাচার মামলার দালালরা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
দালালের বিষয়ে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘সীমান্তের এই পরিস্থিতিতে মধ্যস্থতাকারীদের (দালালদের) আবির্ভাব যেন না ঘটে সেজন্য গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সাধারণ মানুষদের সঙ্গে নিয়ে যাতে কোনও অনুপ্রবেশ না ঘটে, সেজন্য কাজ করছি। পাশাপাশি যদি এ ধরনের কোনও ঘটনা ঘটে, আমরা কঠোরভাবে প্রতিরোধ করবো।’
তবে টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র মুজিবুর রহমান বলেন, ‘নৌপথে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করে থাকে। বিশেষ করে অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে রাতে ভারী বৃষ্টিতে। আমি জানতে পেরেছি, রোহিঙ্গাদের একটি অংশ মিয়ানমারের পাশে নাফ নদীর তীরে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছে।”